জন্ম ও বংশপরিচয়
হযরত আলী (রা.) ৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় এক সম্মানিত কুরাইশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাবা শরিফের অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণকারী একমাত্র ব্যক্তি, যা তাঁকে ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর পিতা আবু তালিব ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের প্রধান এবং নবী করীম (সা.)-এর তত্ত্বাবধায়ক। আলীর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ ছিলেন একজন সৎ ও ধার্মিক নারী। হযরত আলী ছোটবেলা থেকেই ইসলামপূর্ব যুগের বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী (হানিফ) বিশ্বাসে বড় হন।
শৈশব ও নবীজির সঙ্গে সম্পর্ক
আলীর শৈশব থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নবী করীম (সা.) যখন তাঁর চাচা আবু তালিবের কাছে বড় হচ্ছিলেন, তখন আলী নবীজীর সান্নিধ্যে লালিত হন। নবী করীম (সা.) নিজেই তাঁকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। শৈশব থেকেই আলী ছিলেন নবীজীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমনকি নবীজী যখন হেরা গুহায় ধ্যান করতে যেতেন, আলীও তাঁর সঙ্গী হতেন এবং খাদ্য সরবরাহ করতেন।
ইসলাম গ্রহণ
হযরত আলী (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম দিককার অনুসারীদের একজন। মাত্র ৯-১১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণ নবী করীম (সা.)-এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার নিদর্শন। নবী করীম (সা.) তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন:
“আলী আমার থেকে, আর আমি আলীর থেকে।”
(তিরমিজি, হাদিস: ৩৭১৯)
তাঁর এই সম্পর্ক এবং প্রথমদিকের ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসে একটি বিশেষ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
নবীজীর প্রতি আনুগত্য ও হিজরতের ঘটনা
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের রাতে নবী করীম (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কুরাইশরা। এই সময় আলী (রা.) নিজের জীবন বিপন্ন করে নবীজীর বিছানায় শুয়ে থাকেন, যাতে নবীজী নিরাপদে হিজরত করতে পারেন। এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে আলী (রা.)-এর সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ।
ফাতিমার সঙ্গে বিবাহ
নবী করীম (সা.)-এর কন্যা ফাতিমার সঙ্গে হযরত আলী (রা.)-এর বিবাহ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হিজরতের দ্বিতীয় বছরে বদরের যুদ্ধের আগে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখময়, যা ইসলামের আদর্শ দাম্পত্য জীবনের উদাহরণ। তাঁদের দুই পুত্র হাসান ও হুসাইন (রা.) পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা
হযরত আলী (রা.) ইসলামের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বদর, উহুদ, খন্দক এবং খায়বারের যুদ্ধে তিনি অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দেন। খন্দকের যুদ্ধে নবী করীম (সা.) তাঁকে “জুলফিকার” নামে বিখ্যাত তলোয়ার দেন এবং “হায়দার” (সিংহ) উপাধি প্রদান করেন। নবীজী বলেছিলেন:
“যুদ্ধক্ষেত্রে আলীর আঘাত ফেরেশতাদের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।”
(মুসনাদ আহমদ, ২/১৪৫)
হুদাইবিয়ার সন্ধি
ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই চুক্তি লেখার দায়িত্ব পালন করেন হযরত আলী (রা.)। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও কূটনৈতিক দক্ষতা এই চুক্তি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
খিলাফত ও চ্যালেঞ্জ
হযরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হযরত আলী (রা.) চতুর্থ খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর খিলাফতের সময় মুসলিম সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষত সিফফিন ও জামাল যুদ্ধ। এই বিভক্তি ইসলামের ইতিহাসে “ফিতনার যুগ” নামে পরিচিত।
কুফায় গুপ্তহত্যা
৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ রমজান, মসজিদে কুফায় নামাজ আদায়ের সময় হযরত আলী (রা.) খারেজী আব্দুর রহমান ইবনে মুলজামের বিষাক্ত তরবারির আঘাতে গুরুতর আহত হন। মৃত্যুর আগে তিনি নির্দেশ দেন, যদি তিনি মারা যান তবে কিসাস অনুসারে ইবনে মুলজামকে শাস্তি দেওয়া হবে। ২১ রমজান তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং তাঁর পুত্র হাসান (রা.) পিতার নির্দেশনা অনুযায়ী কিসাস সম্পন্ন করেন।
ইসলামে আলী (রা.)-এর অবদান
হযরত আলী (রা.) শুধুমাত্র একজন সাহসী যোদ্ধা নন, তিনি জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ইসলামের ইতিহাসে অনন্য। তাঁর বক্তৃতা, নীতি ও বিচারিক জ্ঞান “নাহজুল বালাগা” নামক গ্রন্থে সংরক্ষিত হয়েছে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো:
“জ্ঞান সম্পদের চেয়ে উত্তম; কারণ সম্পদ তোমাকে রক্ষা করতে হয়, কিন্তু জ্ঞান তোমাকে রক্ষা করে।”
(নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৪৬)
হযরত আলী (রা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র
নাম: আলী ইবনে আবু তালিব
জন্ম: আনু. ৬০১ খ্রিষ্টাব্দ, মক্কা, আরব
মৃত্যু: ২৯ জানুয়ারি, ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ, কুফা, ইরাক
পিতার নাম: আবু তালিব
মাতার নাম: ফাতিমা বিনতে আসাদ
বংশ: বনু হাশিম শাখা, কুরাইশ গোত্র
খিলাফতকাল: ৬৫৬ – ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ
বিবাহ: নবী করীম (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.)
গুণাবলী: সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, প্রজ্ঞাবান, সেরা বিচারক
উপসংহার
হযরত আলী (রা.) ছিলেন সাহসিকতা, জ্ঞান এবং আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ইসলামের জন্য উৎসর্গিত। তাঁর খিলাফত ও নেতৃত্ব মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।