হজরত উমর

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ): ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, ন্যায়বিচার এবং শক্তির প্রতীক

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু (আরবি: عمر بن الخطاب; ৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ – ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। তিনি আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উমর (রাঃ) ছিলেন একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এবং ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে তার বিশেষজ্ঞতা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিল। ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকার কারণে তাকে “ফারুক” (আরবি: الفاروق; সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। এ ছাড়া, আমিরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

শাসনকাল ও খিলাফতের সীমানা
উমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। তার শাসনকালে সাসানীয় সাম্রাজ্য এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময়ে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। উমর (রাঃ) পূর্বের নাসরানী রীতি বদলে ইয়াহূদীদেরকে জেরুসালেমে বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তার জীবনকর্মের উপর শিবলী নোমানীর রচিত “আল ফারুক” বইটি অন্যতম।

প্রথম জীবন
হজরত উমর (রাঃ) মক্কার কুরাইশ বংশের বনু আদি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মায়ের নাম হানতামা বিনতে হিশাম। তার মা বনু মাখজুম গোত্রের সদস্য ছিলেন। যৌবনে তিনি মক্কার নিকটে তার বাবার উট চরাতেন। তার বাবা বুদ্ধিমত্তার কারণে গোত্রে সম্মান লাভ করেছিলেন।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগ ও ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ
৬১০ সালে মুহাম্মদ ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অন্যান্য মক্কাবাসীর মতো উমর (রাঃ) প্রথম পর্যায়ে ইসলামের বিরোধিতা করেছিলেন। তার হাতে মুসলিমরা নির্যাতিত হয়। বিরোধিতার এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার পরিকল্পনা করেন। উমর কুরাইশদের একতায় বিশ্বাস করতেন এবং ইসলামের উত্থানকে কুরাইশদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিবেচনা করতেন।

হযরত উমর এর ইসলাম গ্রহণ
হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রাথমিকভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলেন কিন্তু তাঁর হৃদয়ে সততা এবং ন্যায়পরায়ণতার অটুট প্রগাঢ়তা ছিল। তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী এবং সোজাসাপ্টা মানুষ, যার মনোভাব পরিবর্তনশীল ছিল না। তাঁর ইসলামের প্রতি মনোভাব পরিবর্তনের অন্যতম কারণ ছিল তাঁর অন্তরের সততা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অনুগমন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ, আপনি ওমর বা আবু জাহেলের মধ্যে যে কোনো একজনকে ইসলামের জন্য কবুল করুন।” আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করে হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ইসলামের ছায়ায় আনার সিদ্ধান্ত নেন। (তিরমিজি: ৩৬৮৬)

এই দোয়া এবং আল্লাহর করুণার মাধ্যমে, হযরত উমর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের মহান উপকারিতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। উমরের ইসলাম গ্রহণের পর, তিনি ইসলামের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং তার নেতৃত্বে ইসলামের সম্প্রসারণ এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

উমর (রাঃ) ৬১৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। উমরের ইসলাম গ্রহণের একটি উল্লেখযোগ্য বর্ণনা হলো, তিনি নবী মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে তার বন্ধু নাইম বিন আবদুল্লাহর সাথে দেখা হয়। নাইম গোপনে মুসলিম হয়েছিলেন কিন্তু উমর তা জানতেন না। উমর তাকে বলেন যে তিনি মুহাম্মদকে হত্যা করতে যাচ্ছেন। এ সময় তিনি তার বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে জানতে পারেন।

এ সংবাদে রাগান্বিত হয়ে উমর (রাঃ) তার বোনের বাড়ির দিকে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি বাইরে থেকে কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পান। খাব্বাব ইবনুল আরাত তাদের সুরা তাহা বিষয়ে পাঠ দিচ্ছিলেন। উমর ঘরে প্রবেশ করলে তারা পাণ্ডুলিপিটি লুকিয়ে ফেলেন। কিন্তু উমর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে একপর্যায়ে তাদের উপর হাত তোলেন। তার বোনের বক্তব্যে তার মনে পরিবর্তন আসলে তিনি স্নেহপূর্ণভাবে পাণ্ডুলিপিটি দেখতে চান। এরপর তিনি গোসল করে পবিত্র হয়ে সুরা তাহার আয়াতগুলো পাঠ করেন। এতে তার মন ইসলামের দিকে ধাবিত হয় এবং এরপর তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩৯ বছর।

ইসলাম গ্রহণের পর উমর (রাঃ) আবু জাহলকে তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানান। উমরের ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমরা প্রকাশ্যে কাবার সামনে নামাজ আদায় করার সুযোগ পায়। তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন এবং মুহাম্মদ (সা.) তাকে “ফারুক” উপাধি দেন।

মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যু
মুহাম্মদ (সা.) যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেন, উমর (রাঃ) প্রথমে তা বিশ্বাস করতে চাননি। বিদায় সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং বলেছিলেন যে মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেননি। হযরত আবু বকর এসে ঘোষণা করেন,

“তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদের পূজা করতো, তারা জানুন যে মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতো, তারা জানুক যে আল্লাহ সর্বদাই জীবিত থাকবেন।”

হযরত আবু বকর (রাঃ) কুরআন থেকে তিলাওয়াত করেন:
“মুহাম্মদ একজন রাসুল ছাড়া আর কিছু নন। তার পূর্বে সকল রাসুল গত হয়েছেন। সুতরাং তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন তবে কি তোমরা পিঠ ফিরিয়ে পিছু হটবে?” (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৪৪)

এরপর উমর (রাঃ) সত্য অনুভব করেন এবং শান্ত হন। সুন্নিদের দৃষ্টিতে মৃত্যুর সংবাদ অস্বীকার করা মূলত মুহাম্মদের প্রতি তার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।

খলিফার দায়িত্বগ্রহণ
উমর (রাঃ) কঠোর প্রকৃতির ছিলেন, তাই অনেকে তাকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে সমর্থন করতে চাননি। কিন্তু আবু বকর তাকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করে যান। উমর ছিলেন তার ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণের জন্য পরিচিত।

আবু বকর তার উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টাদের বলেছিলেন:
“আমার কোমলতার জন্য তার (উমর) কঠোরতা ছিল। যখন খিলাফতের ভার তার কাঁধে আসবে তখন সে আর কঠোর থাকবে না।”

হযরত উমর (রাঃ) শাসনকাল
উমরের শাসনকাল ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তার সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং খিলাফতের সীমানা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তিনি প্রশাসনিক এবং সামাজিক নীতি প্রণয়নে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। উমর ছিলেন প্রথম খলিফা যিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেন এবং সমাজে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

তিনি বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ করেন এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার শাসনে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটে, এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় সমন্বয় প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যুর পর
৬৪৪ সালে উমর একজন পার্সিয়ানের হাতে নিহত হন। হত্যাকাণ্ডটি কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পিরুজ নাহাওয়ান্দি (আবু লুলু বলেও পরিচিত) নামক এক পার্সিয়ান দাস উমরের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করেন যে তার মনিব মুগিরার বিরুদ্ধে। উমর (রাঃ) মুগিরার কাছে এই বিষয়ে জানতে চান এবং সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে রায় দেন যে পিরুজের উপর ধার্য করা কর ন্যায্য।

পিরুজ পরে উমরকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে ফজরের নামাজের পূর্বে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে এবং উমরকে ছয়বার ছুরিকাঘাত করে। হামলার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশের লোকেরা তাকে ঘিরে ফেলে এবং সে আরো কয়েকজনকে আঘাত করে। পিরুজ শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে।

উমর তিন দিন পর আঘাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে উমর (রাঃ) তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে বলেন,

“আমি তো জানি না, আল্লাহ আমার সাথে কি করবেন। তবে আমি আশা করি যে আমি আল্লাহর দিকে ফিরে যাব এবং আমি সবার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছি।”

তিনি তার মৃত্যুর পর আবু বকর এবং অন্যান্য খলিফাদের কাছে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

হযরত উমর (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র
  • নাম: হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব
  • জন্ম: ৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ, মক্কা
  • মৃত্যু: ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ, মদীনাহ
  • পিতার নাম: খাত্তাব ইবনে নুফায়েল
  • মাতার নাম: হানতামা বিনতে হিশাম
  • ইসলাম গ্রহণের বছর: ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দ
  • খলিফা হিসেবে শাসনকাল: ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ
  • মহৎ গুণাবলি: ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক চিন্তাধারা, আইনজ্ঞ
  • বিখ্যাত উপাধি: আল ফারুক

উপসংহার
উমরের জীবন ও কর্মকাণ্ড আমাদের জন্য একটি মহান শিক্ষা। তার ন্যায়পরায়ণতা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ইসলামের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চরিত্র ও নেতৃত্বের গুণাবলি এতই মহান ছিল যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ তার সম্পর্কে বিশেষভাবে বলেছেন, “আমার পরে যদি কোনো নবী থাকত, তবে উমর হতেন।” (তিরমিজি: ৩৬৮৬)

এই হাদিসটি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উমরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ইসলামের জন্য তার বিশাল অবদানকে তুলে ধরে। যদিও ইসলামে রাসূলুল্লাহ ﷺ-ই শেষ নবী, তবুও উমরের ইমানের দৃঢ়তা, ন্যায়বিচারের প্রতি তার অনড় অবস্থান, এবং ইসলামী সমাজে তার অবদান তাকে একটি অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত করেছে। ইসলামী খিলাফতের সময়কালে তার চরিত্র ও নেতৃত্ব মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে।

উমরের প্রতি এই প্রশংসা শুধু তার ব্যক্তিগত গুণাবলির জন্য নয়, বরং তার ইসলামী প্রশাসনিক ক্ষমতা, ধর্মীয় দায়িত্ববোধ এবং সহনশীলতার জন্যও ছিল। তাই, উমরের জীবন আমাদের জন্য নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের এক অমূল্য শিক্ষার প্রতীক হয়ে থাকবে।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *