হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান (আরবি: عثمان بن عفان) ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একজন প্রসিদ্ধ সাহাবি। তিনি ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ সাল পর্যন্ত খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং খলিফা হিসেবে তিনি চারজন খুলাফায়ে রাশিদুনের অন্যতম। হযরত উসমান ছিলেন আস-সাবিকুনাল আওয়ালুনের অন্তর্ভুক্ত (প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী) এবং আশারায়ে মুবাশ্শারার একজন। লজ্জাশীল, ধৈর্যশীল এবং উদার চরিত্রের অধিকারী হওয়ায় তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর শাসনামলে ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং কুরআন সংকলনের উদ্যোগ নেওয়া হয় যা ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান অবদান হিসেবে বিবেচিত। উসমান ইসলামী সমাজে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তাঁর আমলে ইসলামী সাম্রাজ্যের উল্লেখযোগ্য বিস্তার ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী: হযরত মুহাম্মদ (সা.)
“উসমান হলো তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল এবং সবার মধ্যে সবচেয়ে বিনম্র।”
“উসমান তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে লাজুক এবং নির্লজ্জতা থেকে দূরে। আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট।” (সুনান ইবন মাযাহ, হাদিস ৩৭০৩)
পরিবার ও বংশ
হযরত উসমানের উপাধি ছিল জুন-নুরাইন এবং জুল-হিজরাতাইন। তিনি কুরাইশ গোত্রের উমাইয়া শাখার সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতা আফ্ফান এবং মাতা ছিলেন আরওয়া বিনতু কুরাইজ। উসমানের ঊর্ধ্ব পুরুষ আবদে মান্নাফে গিয়ে মুহাম্মদের বংশের সাথে মিলিত হয়েছে। তাঁর নানী বায়দা বিনতু আবদুল মুত্তালিব মুহাম্মদের ফুফু ছিলেন, ফলে তিনি মুহাম্মদের ভাগ্নে।
ইসলাম গ্রহণের পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে তাঁর কন্যা রুকাইয়্যার সাথে বিয়ে দেন। হিজরি দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর মদিনায় রুকাইয়্যা মারা যান। এরপর নবী তাঁর দ্বিতীয় কন্যা উম্মু কুলসুমের সাথে বিয়ে দেন। এই কারণে তিনি মুসলিমদের কাছে ‘জুন-নুরাইন’ বা ‘দুই জ্যোতির অধিকারী’ হিসেবে পরিচিত হন।
প্রাথমিক জীবন
হযরত উসমানের প্রাথমিক জীবনের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই। তিনি কুরাইশ গোত্রের একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তাঁর ব্যবসার জন্য পরিচিতি লাভ করেন। মক্কার সমাজে তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন এবং কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তাঁর ধনসম্পদের জন্য তিনি ‘গণি’ উপাধিতে পরিচিত ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ
হযরত উসমান ৬১১ সালে সিরিয়া থেকে বাণিজ্য করে ফিরে আসার সময় মুহাম্মদ কর্তৃক ইসলাম প্রচারের বিষয়ে জানতে পারেন। তাঁর খালার উৎসাহে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর খালা, সুওদা বিনতে কুরাইজ, তাঁর প্রতি ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রভাব ফেলেন। তিনি আবু বকরকে বলেছিলেন, “তুমি আল্লাহর রাসূলের কাছে যাও এবং তাঁর কথাগুলো শোনো।” পরে উসমান মুহাম্মদের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। উসমান ছিলেন প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম এবং তিনি ইসলামের জন্য নিজের সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
খলিফা হিসেবে শাসনকাল
৬৪৪ সালে খলিফা হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর উসমানের শাসনকাল শুরু হয়। তাঁর শাসনে ইসলামী সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তৃত হয়। ৬৫০ সালে ইসলামী সাম্রাজ্য ফার্স (বর্তমান ইরান) এবং ৬৫১ সালে খোরাসান (বর্তমান আফগানিস্তান) অঞ্চলে প্রসারিত হয়। উসমানের আমলে আর্মেনিয়া বিজয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলকে ইসলামের আওতায় আনেন এবং নতুন নতুন জায়গায় ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করেন।
হযরত উমর (রাঃ) উসমান (রাঃ) সম্পর্কে:
“উসমান (রাঃ) আল্লাহর কাছে শ্রদ্ধেয় এবং উত্তম মানুষ।”
“উসমান আল্লাহর তরফ থেকে মুসলমানদের শাসক নির্বাচিত হয়েছেন তার কোমলতা এবং উত্তম চরিত্রের কারণে।” (সুনান আবু দাউদ)
উসমান ইসলামী সমাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বায়তুল মাল থেকে জনগণের জন্য দেওয়া ভাতা ২৫% বাড়িয়ে দেন, যা উমারের সময় সবার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বিজিত অঞ্চলের কৃষি জমি বিক্রির ওপর উমারের নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে তিনি নতুন কৃষকদের জন্য জমি বিক্রির অনুমোদন দেন। এর ফলে ইসলামী খিলাফতের মুসলিম ও অমুসলিম সবাই অর্থনৈতিক সুফল ভোগ করতে সক্ষম হয়।
ধর্মীয় অবদান
উসমান ইসলামের মৌলিক বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। তিনি কুরআনের সংকলনের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন এবং নিশ্চিত করেন যে কুরআনের সকল পাঠ সঠিকভাবে সংকলিত হয়েছে। তাঁর আমলে কুরআন বিভিন্ন স্থানীয় বর্ণনায় সংকলিত হয় এবং মূল পাঠের সঠিকতা রক্ষা করা হয়।
মৃত্যু
উসমান যেদিন খলিফা নির্বাচিত হন, সেদিন তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু ৬৫৬ সালের ১৭ জুন, হিজরি ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ শুক্রবার আসরের নামাজের পর তাঁকে অত্যন্ত বর্বরভাবে হত্যা করা হয়। উসমান মিসর, বসরা ও কুফার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দ্বারা ঘেরাও হয়েছিলেন এবং তিনি আত্মরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগ না করে শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত, ৮২ বছর বয়সী উসমানকে কোরআন পাঠরত অবস্থায় হত্যা করা হয়।
হযরত আবু বকর (রাঃ) উসমান (রাঃ) সম্পর্কে:
“উসমান এমন একজন মানুষ, যাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালোবাসেন।” (ইবন সাদ)
“উসমান (রাঃ) অত্যন্ত মহৎ চরিত্র ও দৃঢ় বিশ্বাসের অধিকারী।”
হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনচিত্র
- নাম: উসমান ইবনে আফ্ফান
- জন্ম: আনু. ৫৭৯, মক্কা, আরব
- মৃত্যু: ১৭ জুন, ৬৫৬, মদীনা, আরব
- পিতার নাম: আফ্ফান
- মাতার নাম: আরওয়া বিনতু কুরাইজ
- বংশ: কুরাইশ গোত্র, উমাইয়া শাখা
- কর্মকাল: ৬৪৪ – ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ
- বিবাহ: মুহাম্মদের কন্যা রুকাইয়া এবং পরে উম্মু কুলসুম
- গুণাবলী: অতি লাজুক, ধৈর্যশীল, মহানুভব
উপসংহার
উসমান ইবনে আফ্ফান ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন। তাঁর নেতৃত্বে ইসলামী সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয় এবং তিনি ইসলামের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর মৃত্যু ইসলামী ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে এবং মুসলিম সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে। উসমানের শাসনকাল মুসলিমদের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে এবং তাঁর অবদান সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।