ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস জটিল এবং বহুমাত্রিক, যা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত এবং ঐতিহাসিক কারণে গঠিত। এই দুই দেশের বর্তমান শত্রুতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং ইসলামের ভূমিকার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নিচে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পেছনের ইতিহাস এবং এর সঙ্গে ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হলো।

১. ঐতিহাসিক পটভূমি

ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক চারটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়:

ক. ১৯৪৭-১৯৫৩: প্রাথমিক সময়

  • ইরানের অবস্থান: ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনার বিরোধিতা করে ইরান, কারণ এটি আরব-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল। ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলের জাতিসংঘে সংযুক্তির বিরুদ্ধেও ইরান ভোট দেয়। তবে, ইরান ১৯৫০ সালে ইসরায়েলকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা তুরস্কের পর দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
  • ধর্মীয় প্রেক্ষাপট: ইরানে তখন শিয়া ইসলাম প্রধান ধর্ম ছিল, তবে রাজনৈতিকভাবে পাহলভি রাজবংশ পশ্চিমাপন্থী এবং ইসলামী মৌলবাদের প্রভাব কম ছিল।

খ. ১৯৫৩-১৯৭৯: বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক

  • পাহলভি রাজবংশের যুগ: মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়। এই সময়ে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। ইসরায়েলকে আরব দেশগুলোর বিপরীতে ভূ-কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখা হতো।
  • ইরাক-ইরান যুদ্ধে সহযোগিতা: ১৯৮০-৮৮ সালের ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইসরায়েল গোপনে ইরানকে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে, কারণ উভয় দেশ ইরাক ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাধারণ শত্রু হিসেবে বিবেচনা করত।
  • ধর্মীয় প্রভাব: এই সময়ে ইরানের শাসনব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, এবং শিয়া ইসলামের রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত ছিল।

গ. ১৯৭৯: ইসলামি বিপ্লব ও সম্পর্কের অবনতি

  • ইসলামি বিপ্লবের প্রভাব: ১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব পাহলভি রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানকে একটি শিয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করে। এই বিপ্লব ইরানের বৈদেশিক নীতিকে আমূল বদলে দেয়। ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ইসরায়েলকে “ইহুদিবাদী শাসন” হিসেবে অভিহিত করে, যাকে তারা অবৈধ মনে করে।
  • ইসলামের ভূমিকা: শিয়া ইসলামের মাধ্যমে ইরান ফিলিস্তিনি মুসলিমদের সমর্থনকে অগ্রাধিকার দেয়। ইরান তেহরানে ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে এটি ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) হাতে তুলে দেয়। ইসরায়েলকে “ছোট শয়তান” এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে “বড় শয়তান” হিসেবে অভিহিত করা হয়।
  • ফিলিস্তিন ইস্যু: ইরান মসজিদুল আকসা ও বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুসলিমদের পবিত্র স্থান হিসেবে গুরুত্ব দেয়। কুরআনে বিলাদ আশ-শাম (বর্তমান ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান) অঞ্চলের পবিত্রতার উল্লেখ এবং মহানবী (সা.)-এর মিরাজের ঘটনা এই অঞ্চলকে মুসলিমদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ করে। ইসরায়েলের ফিলিস্তিন দখলকে ইরান ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে করে।

ঘ. ১৯৯১-বর্তমান: প্রকাশ্য শত্রুতা

  • প্রক্সি যুদ্ধ: ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রকাশ্য শত্রুতা তীব্র হয়। ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদের মতো ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং ইরানের অভ্যন্তরে গুপ্তহত্যা ও সাইবার হামলা চালায়।
  • সিরিয়া ও লেবানন: ইরান সিরিয়ার সরকার এবং লেবাননের হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেয়, যখন ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের সামরিক অবকাঠামোতে হামলা চালায়। ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে ইরানের সমর্থন হিজবুল্লাহকে শক্তিশালী করে।
  • ২০২৫-এর সংঘাত: ২০২৫ সালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত তীব্র হয়। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যার জবাবে ইরান তেল আবিব ও জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করে। এই হামলায় উভয় পক্ষে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়।

২. ইসলামের ভূমিকা

ইসলাম, বিশেষত শিয়া ইসলাম, ইরানের ইসরায়েলবিরোধী অবস্থানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে:

  • শিয়া মতবাদ: ইরানের শিয়া ইসলামি শাসনব্যবস্থা ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের উপর অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে দেখে। আয়াতোল্লাহ খোমেনি ফিলিস্তিনকে মুসলিম বিশ্বের মুক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা শিয়া মতবাদের “মজলুম” (নিপীড়িতদের পক্ষে লড়াই) ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
  • আল-কুদস দিবস: ১৯৭৯ সাল থেকে ইরান প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার আল-কুদস দিবস পালন করে, যা ফিলিস্তিনের সমর্থনে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের দিন হিসেবে পরিচিত।
  • ইসলামি ঐক্য: ইরান শিয়া-সুন্নি ঐক্যের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করার চেষ্টা করে, যদিও সুন্নি-শিয়া বিভেদ এই প্রচেষ্টাকে জটিল করে।

৩. মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির প্রেক্ষাপট

  • ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতা: ইরান ও ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য প্রতিযোগিতা করে। ইরানের “প্রতিরোধের অক্ষ” (Axis of Resistance) হিজবুল্লাহ, হামাস এবং সিরিয়ার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রভাব মোকাবিলা করে। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাবকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখে।
  • মার্কিন ভূমিকা: ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের পতন এবং ২০২০ সালে কাসেম সোলাইমানির হত্যায় মার্কিন হস্তক্ষেপ ইরানের শত্রুতা বাড়ায়।
  • আরব দেশগুলোর অবস্থান: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সুন্নি দেশগুলো ইরানের প্রভাব কমাতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে (যেমন, আব্রাহাম চুক্তি), যা ইরানকে আরও বিচ্ছিন্ন করে।

৪. সাম্প্রতিক সংঘাত (২০২৫)

  • ইসরায়েলি হামলা: ২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে বড় ধরনের হামলা চালায়, যাতে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীরা নিহত হয়।
  • ইরানের পাল্টা হামলা: ইরান “অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি” নামে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, যা তেল আবিব ও জেরুজালেমে ক্ষয়ক্ষতি করে।
  • আঞ্চলিক উত্তেজনা: এই সংঘাতে জর্ডান, ইরাক ও সিরিয়া তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। চীন ও রাশিয়া ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করে, কিন্তু রাশিয়া সরাসরি সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

৫. সম্ভাব্য পরিণতি

  • আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি: বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে তেলের বৈশ্বিক সরবরাহে প্রভাব ফেলতে পারে।
  • ধর্মীয় মেরুকরণ: ইরানের শিয়া নেতৃত্ব এবং ইসরায়েলের ইহুদি পরিচয় সংঘাতকে ধর্মীয় মাত্রা দেয়, যা শিয়া-সুন্নি বিভেদকেও জটিল করতে পারে।
  • আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ: জাতিসংঘ এবং অন্যান্য শক্তি সংযমের আহ্বান জানালেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ সংঘাতকে বৈশ্বিক মাত্রা দিতে পারে।

উপসংহার

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মূলে রয়েছে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের ইসরায়েলবিরোধী মতাদর্শ, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থান, এবং মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যের জন্য ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতা। শিয়া ইসলাম ইরানের নীতিকে প্রভাবিত করলেও, এই সংঘাতে অর্থনৈতিক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে (২০২৫) সংঘাত তীব্র হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক শান্তি হুমকির মুখে রয়েছে।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *